৩০৫৭ কবর খোঁড়া শয্যাশায়ী মনু মিয়ার ঘোড়াটি মেরে ফেলল দুর্বৃত্তরা


শেষ ঠিকানার কারিগর মনু মিয়ার গল্প

মানুষের চিরবিদায়ের পথে নিঃস্বার্থ এক সঙ্গী—মনু মিয়া। কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার আলগাপাড়া গ্রামের এই মানুষটি ৪৯ বছর ধরে কবর খুঁড়ে যাচ্ছেন নিঃশব্দে, নিরলসভাবে। মুসলমানদের শেষ গন্তব্য—কবর—তাঁর হাতের ছোঁয়ায় পায় পরম যত্ন আর মমতার ছায়া। মৃত্যু সংবাদ পেলেই তিনি কুন্তি, কোদাল, করাত, ছুরি, দা, ছেনা সহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নিয়ে ছুটে যান কবরস্থানে। বিনিময়ে কখনো চাননি পারিশ্রমিক কিংবা বকশিশ। জীবনের ৬৭ বছরে মনু মিয়া খনন করেছেন ৩,০৫৭টি কবর—শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায়।

তবে এতসব আত্মত্যাগের মাঝেও নিজের দিকে তাকানোর সময় হয়নি তাঁর। দীর্ঘদিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত এই মানুষটি আজ অসুস্থ। সম্প্রতি রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন সংকটজনক অবস্থায়। পাশে আছেন জীবনসঙ্গিনী রহিমা বেগম, যিনি নিঃশব্দে প্রার্থনা করছেন স্বামীর আরোগ্য কামনায়।

জীবনের প্রয়োজনে এবং মৃত্যুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সময়মতো কবরস্থানে পৌঁছাতে মনু মিয়া নিজের ধানি জমি বিক্রি করে কিনেছিলেন একটি ঘোড়া। এই বিশ্বস্ত সঙ্গী তাঁকে নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছে এক কবরস্থান থেকে আরেকটিতে। অথচ মনু মিয়ার এই সংকটময় মুহূর্তে বর্বরতার শিকার হয়েছে তাঁর প্রিয় সেই ঘোড়াটি।

গত তিনদিন ধরে নিখোঁজ ছিল ঘোড়াটি। ১৬ মে, শুক্রবার সকালে মিঠামইনের হাশিমপুর ছত্রিশ গ্রামের এক মাদরাসার পাশে পানির মধ্যে ঘোড়াটির রক্তাক্ত মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেন এলাকাবাসী। ঘোড়াটির বুকে ছিল ধারালো অস্ত্রের গভীর আঘাত। এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের খবর মনু মিয়াকে জানানো হয়নি এখনও—চিকিৎসাধীন এই মানুষটির মানসিক অবস্থা ভেবে স্ত্রী ও স্বজনেরা রেখেছেন গোপন।

ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়েছিলেন আলগাপাড়ার তিন যুবক, তাঁদের একজন এসএম রিজন। তিনি জানান, স্থানীয়দের বক্তব্য অনুযায়ী, ঘোড়াটি নাকি শাওন নামের এক যুবকের স্ত্রী ঘোড়াকে আঘাত করেছিল, সেই ‘অপরাধে’ মনু মিয়ার ঘোড়াটিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। অভিযুক্ত শাওনের বাবার নাম আজমান, এবং চাচা হাসান মাস্টার।

রহিমা বেগম কাঁদতে কাঁদতে বলেন, "উনার অবস্থা ভালো না। আল্লাহর রহমতেই উনি সুস্থ হতে পারেন। কোনোদিন কারও ক্ষতি করেননি উনি। এতোদিন ভাবতাম মানুষ উনাকে ভালোবাসে। এমন একটা সময়ে, উনার চোখের সামনে না নিয়ে, কেমন করে ওনার প্রিয় সঙ্গীটাকে মানুষ মেরে ফেলতে পারল?"

এ প্রসঙ্গে কিশোরগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) মুকিত সরকার বলেন, ঘটনার তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ দেওয়া হবে।


এই গল্প শুধু এক মানুষ আর এক ঘোড়ার নয়; এটি এক নিঃস্বার্থ জীবনের, নির্মল ভালোবাসার, এবং এক নির্মম সমাজ বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন

Choose Your Language