গ্রীষ্ম, বিদ্যুৎ আর বাস্তবতার পাঠ
ড. ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী
পরিচালক, জ্বালানি ও টেকসই গবেষণা ইনস্টিটিউট; অধ্যাপক, তড়িৎকৌশল বিভাগ, বুয়েট
গ্রীষ্ম যত ঘনিয়ে আসছে, বিদ্যুৎ নিয়ে আলোচনা ততই বাড়ছে। কারণ সুস্পষ্ট—তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুতের চাহিদাও বাড়ে। গরম বাড়লে এসি, ফ্যানের ব্যবহার বাড়ে, ফলে বাড়ে বিদ্যুৎ চাহিদা। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ এই চাহিদা সামাল দিতে না পারলে লোডশেডিং অনিবার্য হয়ে পড়ে।
তবে বিদ্যুৎ নিয়ে ভাবনার শেষ এখানেই নয়। এই ব্যবহারের পেছনে একটি বড় গল্প লুকিয়ে আছে—জলবায়ু পরিবর্তন এবং জ্বালানি অর্থনীতি।
বিদ্যুৎ, জীবাশ্ম জ্বালানি এবং উষ্ণতা
বিশ্বের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে আসে। এগুলো থেকে নির্গত গ্রিনহাউজ গ্যাস পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ফলে উষ্ণতা বাড়ে, গরম পড়ে বেশি, মানুষ আরও বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার করে শীতলতা পেতে। অর্থাৎ, আমরা এক প্রকার চক্রবদ্ধ উষ্ণায়নের ফাঁদে পড়ে যাচ্ছি।
বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বিকল্প নবায়নযোগ্য উৎস যেমন সৌর, বায়ু বা জলবিদ্যুৎ রয়েছে, তবে এগুলোর শক্তি ঘনত্ব (energy density) অনেক কম এবং সঞ্চালনও সীমিত। সৌরশক্তি আপনি বয়ে নিয়ে যেতে পারবেন না, কিন্তু তেল বা গ্যাস আপনি জাহাজে বা পাইপলাইনে বহন করতে পারবেন।
লোডশেডিং: সমাধান না হলেও বাস্তবতা
চাহিদা যখন বেড়ে যায় এবং জোগান কম থাকে, তখনই ঘটে লোডশেডিং। এটাই বাস্তবতা। গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ চাহিদা বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে ১৮ হাজার থেকে ১৮,৫০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত। এই চাহিদা মেটানো সম্ভব—তবে শর্ত একটাই: সব কেন্দ্র সচল থাকতে হবে এবং জ্বালানি সরবরাহ অব্যাহত থাকতে হবে।
কিন্তু তেল ও গ্যাস বিদেশ থেকে কিনতে হয়, যার জন্য দরকার ডলার। এখন এই ডলারই ঘাটতির জায়গা। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হলে ব্যয়বহুল জ্বালানি আমদানি করতে হয়, যা কোষাগারের ওপর চাপ ফেলে।
‘গুড গভর্নেন্স’ বনাম বিলাসিতা
সরকার কিছু সাশ্রয়ী পদক্ষেপ নিচ্ছে—অদক্ষ বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ, সিস্টেম লস কমানো, ক্যাপাসিটি চার্জ হ্রাস, স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানো। এগুলো অনেকটা সতর্ক গৃহস্বামীর মতো পরিকল্পিত খরচ—যিনি প্রতিদিনের চাহিদা বুঝে খরচ করেন, অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার এড়িয়ে যান।
সমাধান কোথায়?
লোডশেডিং পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব না হলেও, প্রাত্যহিক জীবনে দক্ষতা আনা গেলে এর প্রয়োজন কমবে। যেমন:
-
এক ঘরে একাধিক ব্যক্তি একই এসি বা ফ্যান ব্যবহার করা
-
অপ্রয়োজনীয় বাতি ও যন্ত্র বন্ধ রাখা
-
ভবনের নকশায় প্রাকৃতিক আলো-বাতাস নিশ্চিত করা
-
কারখানায় দক্ষ যন্ত্র ব্যবহার
-
ইজিবাইক চার্জিংকে নির্দিষ্ট বিলের আওতায় আনা
-
কৃষিখেতে সৌরশক্তি ব্যবহার
-
দেশি কয়লার যুক্তিসঙ্গত ব্যবহার
-
ইনকুবেশন ও শীতাতপ ব্যবস্থায় সোলার প্রয়োগ
এই ছোট ছোট পদক্ষেপ, দিনশেষে বিদ্যুৎ চাহিদা কমাতে পারে, লোডশেডিং হ্রাস করতে পারে এবং জ্বালানি খাতে সাশ্রয় নিশ্চিত করতে পারে।
উপসংহার
গরম মানেই এসি চালানো, এসি মানেই বিদ্যুৎ, বিদ্যুৎ মানেই জ্বালানি—এই সরল সমীকরণের ভেতরেই জড়িয়ে আছে বৃহৎ অর্থনীতি, পরিবেশ এবং জনজীবনের হিসাবনিকাশ। এখন সময়, ব্যক্তিগত এবং রাষ্ট্রীয় উভয় পর্যায়েই সচেতন ব্যবস্থাপনা গ্রহণের।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন