সাউন্ড গ্রেনেডের আতঙ্ক: স্বাধীন দেশে নাগরিক নিরাপত্তা নাকি ভয়ের হাতিয়ার?



২০২৩ সালের জুলাই-আগস্ট মাসের আন্দোলন আমাদের মনে গেঁথে দিয়েছে ভয়ের এক নতুন সংজ্ঞা। কর্মসূত্রে ১৯ থেকে ২৯ জুলাই পর্যন্ত রাজপথে থাকাকালীন আমি নিজে প্রত্যক্ষ করেছি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসের নির্বিচার ব্যবহারের দৃশ্য।

বিশেষ করে রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোডের বিক্ষোভে, হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া সাউন্ড গ্রেনেডের বিকট শব্দ ও তীব্র আলো এখনো কানে ও মনে প্রতিধ্বনিত হয়। শারীরিকভাবে বড় ক্ষতি না হলেও দিনের পর দিন স্বাভাবিকভাবে শুনতে না পারার অভিজ্ঞতা আমার জীবন থেকে মুছে যায়নি।

একজন নাগরিক হিসেবে প্রশ্ন জাগে—একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কীভাবে নিজের জনগণের বিরুদ্ধে এমন ভয়ঙ্কর হাতিয়ার ব্যবহার করতে পারে?

ভয়ের খবর

জুলাই আন্দোলনের সময়ের পত্রপত্রিকায় আমরা পড়েছি—

  • সিলেটে শিক্ষার্থীদের পদযাত্রায় পুলিশের বাধা ও সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার (প্রথম আলো, ৩১ জুলাই)।

  • ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কফিন মিছিল চলাকালে সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ (প্রথম আলো, ১৭ জুলাই)।

  • পুলিশের দাবি: ককটেল নয়, সাউন্ড গ্রেনেড (প্রথম আলো, ৩০ জুলাই)।

এমন অসংখ্য খবর সাক্ষ্য দেয় যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে উন্মুক্ত জনসমাবেশেও পুলিশের এই ধ্বংসাত্মক হাতিয়ারের ব্যবহারে আতঙ্ক ছড়ানো হয়েছিল।

সাউন্ড গ্রেনেড: উৎস ও ব্যবহারের প্রেক্ষাপট

২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে জানা যায়, বাংলাদেশ পুলিশ ৫২ হাজার সাউন্ড গ্রেনেড কেনার জন্য প্রায় ২০ লাখ টাকার বাজেট নির্ধারণ করে। এর আগেও ২০১৬ সালে ব্রাজিল থেকে এবং ২০০৯ সালে চীন থেকে বিশাল পরিমাণ সাউন্ড গ্রেনেড আমদানি করা হয়েছিল। অর্থাৎ জনগণের ট্যাক্সের অর্থ ব্যবহার করা হয়েছে, আবার সেই জনগণেরই মুখ বন্ধ করতে।

শরীর ও মনের উপর বিধ্বংসী প্রভাব

সাউন্ড গ্রেনেড বা ফ্ল্যাশবাং:

  • ১৭০-১৮০ ডেসিবলের তীব্র শব্দ উৎপন্ন করে।

  • ১ মিলিয়ন ক্যান্ডেলার সমান আলোর ঝলক সৃষ্টি করে।

  • এই বিস্ফোরণের ফলে শ্রবণশক্তি হারানো, অস্থায়ী অন্ধত্ব, মস্তিষ্কের অস্থিরতা, পিটিএসডি-র মতো মানসিক ব্যাধি দেখা দিতে পারে।

  • বিশেষ করে শিশু ও দুর্বল স্বাস্থ্যবিশিষ্ট মানুষের ওপর এর প্রভাব আরও বেশি ভয়াবহ।

এ ধরনের সরঞ্জাম ব্যবহারের মানসিক অভিঘাত কখনোই কেবল সাময়িক আতঙ্ক নয়; এটি চিরস্থায়ী ভয়ের জন্ম দেয় নাগরিক মনে।

নাগরিকদের প্রশ্ন: কে দেবে উত্তর?

আমরা একটি মৌলিক প্রশ্ন তুলছি:
একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশে জনগণের বিরুদ্ধে সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার কতটা যুক্তিযুক্ত?

আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নামে যদি জনগণের ওপর ভয় সৃষ্টি করা হয়, তবে সেটি জননিরাপত্তা নয়, বরং রাষ্ট্রের শক্তি প্রদর্শনের নির্লজ্জ উদাহরণ।

দাবি ও সুপারিশ

১. সাউন্ড গ্রেনেডের নিষিদ্ধকরণ:
শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে এর ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে।

২. ক্ষতিপূরণ প্রদান:
সাউন্ড গ্রেনেডের কারণে আহত বা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

৩. রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধ:
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে না।

  1. স্বচ্ছ ক্রয়পদ্ধতি:
    পুলিশের সরঞ্জাম কেনাকাটায় সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।

৫. মানবিক প্রশিক্ষণ:
পুলিশ সদস্যদের মানবিক আচরণ ও সহনশীলতার ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণ দিতে হবে। শান্তিপূর্ণ জনসমাবেশে অহিংস পদ্ধতি অবলম্বন করা উচিত।

৬. আইনি কাঠামোতে অস্ত্র ব্যবহারের নিয়ন্ত্রণ:
স্পষ্ট ও কঠোর আইনের আওতায় অস্ত্র ব্যবহারের অনুমোদন দিতে হবে, যাতে অকারণে জনগণের ওপর বলপ্রয়োগ না হয়।


আমরা চাই মানবিক, দায়িত্বশীল ও জনবান্ধব আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, যারা জনগণের নিরাপত্তার সুনিশ্চিতকরণে কাজ করবে, আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য নয়।

সাউন্ড গ্রেনেডের বিকট শব্দের বিরুদ্ধে আমাদের দাবি:
ভয় নয়, মানবিকতা চাই।


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন

Choose Your Language